Skip to content

সুখ-ছবি-আলাপ! সঙ্গে শাহীন দিল রিয়াজ

ছবিমেলার দশম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনেই দেখা হয়ে গেল শাহীন দিল রিয়াজের সাথে। গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ছাদে সান্ধ্য আলাপে উঠে আসলো মেলায় প্রদর্শনাধীন তথ্যচিত্র শিল্প শহর স্বপ্নলোক (২০০৫) এবং অন্যান্য কাজের টুকরো ভাবনাসমূহ। 

উল্লেখ্য, এই কথোপকথন চলচ্চিত্রকারের সামগ্রিক কাজকে প্রতিফলিত করে না বা তা করার উদ্দেশ্যও আমার ছিল না। এখানে নেই কিন্তু এমন অনেক প্রসঙ্গ আছে যা নিয়ে আলাপের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি। মাত্র আধ ঘন্টার আলাপে বিক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নাবলী আলোচনাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

আরিফ আরমান বাদল: শাহীন ভাই, আপনার তথ্যচিত্রগুলোতে কথক আলাদা চরিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সিনেমার চরিত্রদের সাথে ক্রমাগত কথা বলে এবং মেশে। এই পন্থার মাধ্যমে আপনি ডকুমেন্টরিরর যে প্রথাগত ধারণা তা থেকে বের হয়ে এসে এক ধরণের ডকু-ফিকশনের রূপ দেন। পরিচালক হিসেবে নিজেকে ফিকশনাইজড করার দরকার পড়ল কেন? 

শাহীন দিল রিয়াজ: পরিচালক হিসেবে আমি নিজেকে কতটুকু ফিকশনাইজড করবো সেটা নির্ভর করে আমার মর্জি, পরিচালকের সাথে সিনেমার চরিত্রের সম্পর্ক এবং এর বিষয়ের উপর। আবার অনেক পরিচালক দ্বিধার মধ্যে থাকেন আসলে তিনি সিনেমার মধ্যে কতটুকু উপস্থিত হবেন। আমার সেই দ্বিধা নেই। তাছাড়া আমি যেহেতু একইসাথে চিত্রগ্রাহক এবং পরিচালক…

বাদল: আবার সিনেমা সম্পাদনাও করেন…

দিল রিয়াজ : হ্যাঁ, এডিটিংও করি। তবে আমার একজন ডেডিকেটেড এডিটর থাকে। তো, সিনেমাটোগ্রাফি করতে করতেই আমি ডিরেক্টর হয়ে গেলাম। যেহেতু আমি এই দুই কাজ একইসাথে করি তাই ক্যামেরার সামনের মানুষদের সাথে আমার এক ধরণের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। যেটা শুধুমাত্র পরিচালক হলে হয়তো ওভাবে হতো না। আবার অনেক সময় শ্যুটিংয়ের মধ্যে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায়। তখন চরিত্রগুলো ক্যামেরার পিছনের মানুষের কাছে জানতে চায় বা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় কথা বলার জন্য। আর ঠিক তখনই ক্যামেরার পিছনের মানুষটি স্বয়ংক্রিভাবেই ফিকশনাইজড হয়ে যায়। এখন আমি এই মিথস্ক্রিয়া রাখবো কিনা সেটা প্রশ্ন। আমার ক্ষেত্রে আমি তো চাই খুব ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সিনেমাটাকে নির্মাণ করতে, তাদের সাথে কথা বলতে। সুতরাং আমি পরিচালক স্বভাবতই চরিত্র হিসেবে সিনেমার অংশ হয়ে উঠি। 

বাদল: এখন আপনার প্রথম দুটি সিনেমা জীবন জলেবেলে (২০০২) এবং শিল্প শহর স্বপ্নলোকে’তে (২০০৫) যেভাবে ঢালাওভাবে পরিচালকের অংশগ্রহণমূলক কথোপকথনের মাধ্যমে ন্যারেটিভ এগিয়েছে তেমনিভাবে পরের সিনেমা লোহাখোরে (২০০৮) তা দেখা যায়নি। চরিত্র হিসেবে পরিচালকের অংশগ্রহণ এখানে কমে গেল কেন? 

দিল রিয়াজ : এটা খুবই সহজ কারণ। প্রথমত জীবন জলেবেলে (২০০২) আমার গ্রাজুয়েশন ফিল্ম। চিত্রগ্রাহক, পরিচালক হিসেবে সেটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতাও। সিনেমাটোগ্রাফির শিক্ষার্থী হওয়ায় এই সিনেমা যে আমি নিজে পরিচালনা করবো সেরকম পরিকল্পনাও ছিল না। গ্রাজুয়েশন ফিল্মের শর্তানুযায়ী কিছু ফুটেজ নেওয়াই আমার মূখ্য কাজ ছিল।

বাদল: ব্যাবেলসবার্গ ফিল্ম স্কুলে?

দিল রিয়াজ: হ্যাঁ। তো আমিই উদ্যমী হয়ে ক্যামেরা নিয়ে বাংলাদেশের চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপন ধারণ করতে চলে গিয়েছিলাম। এই তথ্যচিত্র নির্মাণে এক ধরণের স্বাধীনতা ছিল। আমার প্রফেসররাও জানতে চাইনি গ্রাজুয়েশন ফিল্ম হিসেবে আমি কি শ্যুট করছি, কেন করছি। কারণ এটা থেকে যে একটা ছবি হবে এটাও কেউ আশা করেনি। ছবিটিতে আমি যা ইচ্ছা তাই করেছি। চরিত্রদের সাথে কথা বলেছি, হাসি ঠাট্টা করেছি। আর এটাই ছবিটিকে আরও ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে। মনে হয়েছে, পরিচালকের সাথে চরিত্রের এই কথোপকথনগুলো রাখলে সেটা সিনেমায় নতুন কিছু যোগ করবে, একটা ব্যক্তিগত সিনেমা হবে। আর দ্বিতীয় সিনেমার (শিল্প, শহর স্বপ্নলোক) ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কথোপকথনের প্রয়োজন পড়েছে। কেননা এর কনসেপ্টটাই ছিল এরকম। সিনেমার প্রধান চরিত্রসমূহের সাথে পরিচালকের একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, সুতরাং স্বভাবতই একটা মিথস্ক্রিয়া হয়েছে। চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত গল্পও উঠে এসেছে। সেখানে আবার পরিচালকের শৈশবও জড়িত। 

কিন্তু লোহাখারের (২০০৮) গল্পের সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল না। এদের পৃথিবীটা ভিন্ন। সুতরাং আমি ওখানে যদি অযাচিত হয়ে কথা বলতে যাই কিংবা সম্পর্ক তৈরি করতে যাই সেটা কাজ করবে না। কারণ তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তাই সিনেমাটিতে যতটুকু পরিচালকের কথা আসছে সেটা খুব প্রয়োজনের খাতিরেই এসেছে। তাছাড়া এতে যে ধারাবিবরণী আমি ব্যবহার করেছি সেটা ব্যক্তিগত নয়, বরং অনেক বেশি তথ্যবহুল। 

বাদল: সিনেমা ব্যক্তিগত হওয়ার কথা আপনি বলেছেন। আপনার সিনেমাগুলো দেখলে মনে হয় সেটা অনেক বেশি যাপনের সাথে জড়িত। প্রথম দিককার সিনেমাগুলোতে সেটা অনেক বেশি প্রকট। সিনেমা কিংবা যেকোন প্রকারের শিল্পের সাথে চলচ্চিত্রকার অথবা শিল্পীর যাপন জড়িত হওয়ার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন? 

দিল রিয়াজ : আচ্ছা। এটার আসলে দুটো দিক আছে। প্রথমত আপনি যে বিষয় বা চরিত্রের উপর ছবি বানাচ্ছেন তারা যদি আপনার পরিচিত হয়, স্বদেশী হয় তাহলে এক ধরণের ছবি হবে। এখন আপনি যদি জার্মানীতে গিয়ে সিনেমা বানান তাহলে সেটা এক ধরণের হবে। কেননা, আপনি ওই ইউরোপীয় মানুষদের মানসিকতা, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেন না। তাই আপনি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে ইউরোপে গিয়ে সিনেমাটা বানাবেন স্বভাবতই সেটা নতুন একটা ভিউপয়েন্ট তৈরি করবে যেটা জার্মানরা বানালে অনুপস্থিত থাকবে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমার মতো যারা ক্রস কালচারে কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। অথচ আমি ২৭ বছর ধরে জার্মানীতে বসবাস করছি। ওখানকার পাবলিক টেলিভিশনের জন্য কন্টেন্ট বানাই। আমার ক্রু’র ৮০ শতাংশই জার্মান। এই ক্রু নিয়ে আমি যখনই আমার স্থানীয় সমাজকে চিত্রায়িত করি তখন এমন অনেক বিষয় আছে যা আমার চোখে এড়িয়ে যায় কিন্তু ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আবার আমার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেটা ওদের কাছে মনে হয় না। 

বাদল: কি রকম?

দিল রিয়াজ: যেমন, আশি-নব্বই দশকে এখানকার বিবাহ পূর্ববর্তী প্রেমের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হতো না। তো আমি যখন এই ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে চেয়েছি তখন ওরা ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি। বলেছে, তোমাদের রক্ষণশীল সমাজে যে এরকম হবে তা খুবই অনুমেয়। বরং ওরা যমুনা নদীর চরের ভিতরে দেখতেছে দুটি ছেলে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে। জানতে চাচ্ছে ওরা সমকামী কিনা। কিন্তু এমনটা তো স্বাভাবিকভাবেই হয় আমাদের সমাজে। হাত ধরে গলাগলি করে দুই ছেলে বন্ধু হাঁটেই। তো এটা আমার চোখে কখনোই পড়বে না। কিন্তু ওরা এটাকে অন্যভাবে ‘রিড’ করে। তো আমি যখন এটা দেখাবো সিনেমাতে তখন ওরা চায় যে আমি এই ব্যাপারটিকে বিশ্লেষণ করি নইলে ওদের দেশে সেটা ভুল বার্তা দিতে পারে। ছবির পুরো গল্পটিই ভুলভাবে উপস্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

 সুতরাং, ছবি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সমাজ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এগুলো বড় বিষয় হিসেবে কাজ করে। পরিচালকের যাপিত জীবনের গল্প সিনেমায় দেখালে সেটার এক ধরণের প্রভাব আছে আবার চেনা গণ্ডি থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ বৈদেশিক বিষয় নিয়ে ছবি করলে তার প্রভাব ভিন্ন হবে। 

বাদল: রণেশ দাশ গুপ্ত সত্যজিত রায়ের অপরাজিত (১৯৫৭) সিনেমার একজন কমিউনিস্ট চরিত্র নিয়ে লিখেছেন। সত্যজিত তার সিনেমাতে ক্ষুদ্র পরিসরেও বামপন্থী চরিত্র হাজির করেছেন যা তার রাজনৈতিক দর্শনকে বিবৃত করতে পারে। শিল্প শহর স্বপ্নলোকে(২০০৫) মার্কসবাদী চরিত্র হাসান, যে আবার আপনার বন্ধুও। এই হাসানকে পর্দায় দেখানোর মাধ্যমে আপনি নিজেকে দেখতে চেয়েছেন কিনা? বা এই চরিত্রের অন্তর্ভূক্তিতে পরিচালক বা ব্যক্তি রিয়াজের অভিসন্ধিটি কি ছিল? 

দিল রিয়াজ : চরিত্র হিসেবে হাসানকে আমি খুবই ইন্টারেস্টিং মনে করতাম এবং এখনও মনে করি। আর এ ধরণের চরিত্র শুধু আমাদের দেশে নয় বরং বিভিন্ন দেশে আছে। বিভিন্ন শহরে আছে। আমার মনে আছে আমি যখন বার্লিনে প্রথম শো করি ওখানে একটা দক্ষিণ কোরিয় মেয়ে বলছিল আমি হাসানের মত। হাসানের সাথে সে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে। এমনকি আমি যখন রিও ডি জেনিরো’তে সিনেমাটি দেখিয়েছিলাম ওখানকার তরুণ ছেলে-মেয়েরাও বলেছিল ওরা হাসানের সাথে নিজেদের চরিত্রের মিল খুঁজে পায়। ওদেরও এরকম বাস্তবতা বিদ্যমান। এরকম স্বাপ্নিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ওদের মধ্যেও আছে। সুতরাং হাসানের এই চরিত্রটি প্রোটোটাইপ যেটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খুঁজে পাওয়া যায়। এখন আমার চরিত্রের সাথে তার কতটুকু মিল আছে তা আমি বলতে পারবো না। তবে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আমার দূর্বলতা রয়েছে।

 তবে হাসানের চরিত্রটি বহুমাত্রিক। সিনেমার প্রথমদিকে তার সম্বন্ধে ভাসা ভাসা জানতে পারি আমরা। কিন্তু পরবর্তীতে একটু একটু করে তার জীবনের ভেতরের তথ্য বের হতে থাকে। এর আগে কিন্তু সে এর তার কথা বলে সময় কাটাচ্ছিল। ঠিক ধরা যাচ্ছিল না তাকে। নিজের জীবনের কথা কমই বলছিল সে। কিন্তু তার দুই বোনের সাথে সাক্ষাতের পরই হাসানের মুখোশ খুলে পড়ে। এই মুখোশ খুলে পড়ার পর আমরা যাকে দেখতে পাই সেখানে যেন আমি নিজেকেও দেখতে পাই। ছবির প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসলে আমি হাসানের বহুমাত্রিক রূপকে আবিষ্কার করেছি। এই চরিত্রকে আমার অলটার ইগোও বলা যেতে পারে।

 বাদল: শিল্প শহর স্বপ্নলোক (২০০৫) সিনেমায় রেফারেন্স হিসেবে জার্মান লেখক জিবিল বার্গের ঢাকা ঘুরে গিয়ে এ শহরকে ‘লিভিং হেল’ বলার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন আপনি। এই সিনেমা কি বার্গের উক্তির কোন প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে?

দিল রিয়াজ : ওরকম কোন উত্তর দিতে চাইনি আমি। আমার মনে হয় পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ কোথায় বাস করে এ ধরণের জেনারালাইজড কথা-বার্তা খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়। সব দেশেরই সংকট আছে, অভাব-অভিযোগ আছে। আবার ওই সব দেশে জীবনও আছে। সুখ-দুঃখ সব কিছু মিলিয়েই জীবন। আমার সিনেমায়ও কিন্তু সেটাই প্রতিফলিত হয়। এটা আসলে এক ধরণের পোর্টে ফিল্ম। এখানে নানাবিধ চরিত্রকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। আর এই চিত্রায়নের ভিতর দিয়েই এই সমাজ তথা দেশ প্রতিফলিত হয়েছে। এটাই হচ্ছে মূলত ছবিটা। এখন এটা সুখ নাকি সুখ না সে তো মানুষ দেখতে পাচ্ছে। সুখ বা অসুখটা মানুষ যেমন বুঝতে পারে ঠিক তেমনি এর পেছনের অনুঘটকটাও ঠাওর করতে পারে।

লেখা – আরিফ আরমান বাদল

চিত্র- জাহিদুল করিম সেলিম, কাওসার আহমেদ

About Us

Contact Us